শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত হওয়ার কারণ
৯ম শ্রেণির সুপ্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, আশা করছি খুবই ভালো আছো। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম মূল্যায়নের লক্ষ্যে প্রকাশিত নবম শ্রেণীর ১৪তম সপ্তাহে এসাইনমেন্ট যা ৩১শে আগস্ট ২০২১ খ্রিঃ তারিখে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণির অ্যাসাইনমেন্ট মাউশি অধিদপ্তর সাইটে প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। আজ তোমাদের নবম শ্রেণি ১৪তম সপ্তাহের চারু ও কারুকলা অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবো। অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম হবে- শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত হওয়ার কারণ।
নবম শ্রেণি ১৪তম সপ্তাহের চারু ও কারুকলা অ্যাসাইনমেন্ট
অ্যাসাইনমেন্ট বা নির্ধারিত কাজ:
১৯৪৩ সালে কেন দুর্ভিক্ষ হয়েছিল? শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত কেন? বর্ণনা কর।
নির্দেশনা (সংকেত/ধাপ/পরিধি):
ক. শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনী ও তাঁর শিল্পকর্ম থেকে।
খ. পাঠ্যপুস্তকে ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে।
গ. জাতীয় জাদুঘর, বই, ইন্টারনেট ইত্যাদি থেকে।
নবম শ্রেণি ১৪তম সপ্তাহের চারু ও কারুকলা অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষঃ
দুর্ভিক্ষ হল কোন এলাকার ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি সাধারণত ফসলহানি, যুদ্ধ, সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্ভিক্ষ সংগঠিত হয়। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গবাদিপশুর মড়ক, পোকাড় আক্রমণ ইত্যাদি কারণেও দুর্ভিক্ষ সংগঠিত হয়।
১৯৪৩ সালে বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে ( খ্রি. ১৯৪৩) এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে এটি পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ১৯৩৮ সাল থেকে কৃষি ফসলের উৎপাদন কমতে থাকে। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনাও এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। জাপানি সেনাবাহিনীর হাতে বার্মার পতন হলে সেখান থেকে বিপুল পরিমান চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য অতিরিক্ত খাদ্যশস্যের চাহিদা, অতিরিক্ত মুনাফাভোগীদের দৌরাত্ম এবং সরকারি অব্যবস্থাপনা এই দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ। এই দুর্ভিক্ষে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বিপুল সংখ্যক মানুষ কলকাতা শহরে মৃত্যুবরণ করে। উল্লেখ্য যে, এদের মধ্যে সবাই কলকাতা শহরের বাইরের বাসিন্দা ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেছেন সে সময় শকুন ও কুকুরে খাওয়া মরদেহ জমিতে ও নদীর ধারে পড়ে থাকার কথা। এতো মৃতদেহের সৎকার করার ক্ষমতাও কারো ছিল না। গ্রামে যাদের মৃত্যু হয়নি তারা খাদ্যের সন্ধানে শহরাঞ্চলে চলে যান।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত হওয়ার কারণ
“প্রত্যেককে কঙ্কালের মতো দেখাতো, মনে হতো শরীরের কাঠামোর ওপরে শুধু চামড়া লাগানো,” বলেন প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দুর্ভিক্ষের সময় তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর।
“ভাত রান্নার সময় যে মাড় তৈরি হয়, লোকজন সেটার জন্য কান্নাকাটি করতো। কারণ তারা জানতো যে তাদেরকে তখন ভাত দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না। একবার যে এই কান্না শুনেছে সে তার জীবনে কখনো এই কান্নার কথা ভুলতে পারবে না। এখনো সেসব নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার চোখে জল চলে আসে। আমি আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।”
বেঙ্গলে এই দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪২ সালের এক ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে। তবে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছিল স্যার উইনস্টন চার্চিল ও তার মন্ত্রিসভার নীতিমালার কারণে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইতিহাসবিদ ইয়াসমিন খান বলেছেন বার্মা থেকে জাপানিরা বেঙ্গল দখল করতে চলে আসতে পারে এই আশঙ্কায় ওই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিলো।
“এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল শস্যসহ সবকিছু ধ্বংস করে ফেলা, এমনকি যেসব নৌকায় শস্য বহন করা হবে সেগুলোও। ফলে জাপানিরা যখন আসবে তারা আর সেখানে টিকে থাকার জন্য সম্পদ পাবে না। এই নীতি গ্রহণের ফলে যেসব প্রভাব পড়েছিল ইতিহাসে সেগুলো ভালো করেই লেখা আছে।”
ভারতীয় প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ সৈন্যদের লেখা ডায়েরিতে দেখা যায়, উইনস্টন চার্চিলের সরকার ভারতে জরুরি খাদ্য সাহায্য পাঠানোর আবেদন কয়েক মাস ধরে বাতিল করে দিয়েছিল। এর পেছনে কারণ ছিল ব্রিটেনে খাদ্যের মজুত কমে যাওয়ার আশঙ্কা এবং যুদ্ধের বাইরে অন্য কাজে জাহাজ মোতায়েন করা। চার্চিল ভেবেছিলেন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় স্থানীয় রাজনীতিকরাই অনেক কিছু করতে পারবেন। বিভিন্ন নোটে ভারতের প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারেও কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত হওয়ার কারণ
আবার,১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারত) বাংলা প্রদেশে দুর্ভিক্ষ। আনুমানিক ২.১-৩ মিলিয়ন বা ২১ থেকে ৩০ লাখ,[ক] ৬০.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে, অপুষ্টি, জনসংখ্যা স্থানচ্যুতি, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং স্বাস্থ্য সেবার অভাবের কারণে অনাহার, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগে মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ লোক দরিদ্র হয়েছিল কারণ এই সংকট অর্থনীতির বড় অংশকে অভিভূত করেছিল এবং সামাজিক কাঠামোকে বিপর্যয়করভাবে ব্যাহত করেছিল। অবশেষে, পরিবারগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; পুরুষরা তাদের ছোট খামার বিক্রি করে এবং কাজ খুঁজতে বা ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, এবং মহিলা ও শিশুরা গৃহহীন অভিবাসী হয়ে ওঠে, প্রায়শই সংগঠিত ত্রাণের সন্ধানে কলকাতা বা অন্যান্য বড় শহরে ভ্রমণ করে।
ইতিহাসবিদরা সাধারণত দুর্ভিক্ষকে নৃতাত্ত্বিক (মানবসৃষ্ট) হিসেবে চিহ্নিত করেন, জোর দিয়ে বলেন যে যুদ্ধকালীন ঔপনিবেশিক নীতিগুলি তৈরি করেছিল এবং তারপরে সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। কিন্তু, সংখ্যালঘু দৃষ্টিভঙ্গি বলে যে দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক কারণে হয়েছিল।
জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি বিখ্যাত হওয়ার কারনঃ
১৯৪৩ সালে আমাদের দেশে যখন মন্বন্তর এল তখন জয়নুল আবেদিন উনত্রিশ বছরের এক প্রাণবন্ত শিল্পী। ইতিমধ্যেই তাঁর কাজের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তথাকথিত শিল্পপ্রেমী নন যাঁরা, তাঁরাও তখন জয়নুলের কাজের সঙ্গে সুপরিচিত। মানুষ ও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে জয়নুল তাঁর কাজকে ছাত্রজীবন থেকেই জনমুখী করে তুলেছিলেন। ক্রমশই তিনি খুঁজে নিচ্ছিলেন নিজস্ব আঙ্গিক, যে আঙ্গিক বিদ্যুতের ফলার মতো ঝলসে উঠছিল তেতাল্লিশের মন্বন্তর পর্বে একগুচ্ছ মর্মস্পর্শী ছবির মধ্যে দিয়ে।
পরাধীন ভারত তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্বিপাকে পড়ে একেবারে মুমুর্ষু অবস্থায়। চল্লিশের দশকের প্রথমে, ব্রিটিশ সরকার ও তার সঙ্গী এদেশেরই কিছু সুযোগসন্ধানী স্বার্থপর মানুষের চক্রান্তে বাংলার কয়েক কোটি মানুষ অনাহার ও অর্ধাহারের কবলে পড়ে। দেশজুড়ে দেখা যায় চরম খাদ্যসংকট। নিরন্ন মানুষের শবদেহে ভরে ওঠে গ্রাম–শহরের রাস্তাঘাট। এইসময় জয়নুল আবেদিন থাকতেন কলকাতার ১৪ নম্বর সাকসি রোডের একটি বাড়িতে। তাঁর তখন কাজ ছিল সারাদিন ধরে কলকাতার পথে ঘুরে ঘুরে খাদ্যহীন–বস্ত্রহীন মানুষের দুর্দশার ছবি এঁকে বেড়ানো। এইভাবে শতশত স্কেচ করেছিলেন তিনি।
তার মধ্যে নির্বাচিত বারোটি স্কেচ নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন অবিস্মরণীয় একটি অ্যালবাম, যার নাম ছিল ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’। এই অ্যালবামটি গ্রন্থণা করেছিলেন ইলা সেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অ্যালবামটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে। বুভুক্ষু মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা শিল্পীর তুলিতে কী হৃদয়বিদারক রূপ পরিগ্রহ করতে পারে তার জ্বলন্ত নিদর্শন ছিল জয়নুলের সেই চিত্রমালা। তার আগে এদেশের কেউ ভাবতেও পারেননি যে এইভাবে একজন শিল্পী ছবি আঁকতে পারেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত হওয়ার কারণ
মৃত মায়ের বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা শিশু, স্ত্রীর শবদেহের পাশে আর্তনাদরত স্বামী, ডাস্টবিনে খাবারের খোঁজে উন্মত্ত মানুষ ও কুকুর, মৃত মানুষের চোখ ঠুকরে খাচ্ছে এক দঙ্গল কাক — এইসব দুঃসহ দৃশ্যও যে ছবি হয়ে উঠতে পারে, আর তার প্রকাশভঙ্গিও যে এতটাই তীব্র হতে পারে জয়নুলের ছবির আগে তার কোনও নিদর্শন এদেশ দেখেনি। যদিও একথা উল্লেখ্য যে সেই সময় তাঁর পাশাপাশি চিত্তপ্রসাদের মতো কতিপয় শিল্পী অসাধারণ কিছু ছবি এঁকেছিলেন একই বিষয়ে। তবু জয়নুল আবেদিনের কাজ ছিল স্বভাব–স্বতন্ত্র।
তেলরঙের চ্যাপ্টা ব্রাশ শুধুমাত্র কালো কালিতে ডুবিয়ে জয়নুল যে সমস্ত রেখাচিত্রের জন্ম দিয়েছিলেন বাস্তবিকই সেগুলি ছিল অতুলনীয় এবং অবিশ্বাস্য। রেখার মধ্যে দিয়ে কান্না ও ক্রোধের এমন ধারাবাহিক প্রকাশ আজ অবধি দুর্লভ। ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’ অ্যালবামটির জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকার সেটিকে বাজেয়াপ্ত করে। সংকলনটিকে দর্শকের সামনে থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন শিল্পী ও প্রকাশক। কিন্তু ততদিনে অগুনতি মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলে দিয়েছে ছবিগুলি।
আজও সেই চিত্রমালা দুর্ভিক্ষের স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন হয়ে চিত্রপ্রেমীদের মনের কোনে রয়ে গেছে। একজন শিল্পীর পক্ষে এ বড় কম সম্মানের কথা নয়। আজও যখন এই দেশ কিংবা এই পৃথিবীর কোনও প্রান্তে অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসে তখন জয়নুলের ‘ডার্কেনিং ডেজ অফ বেঙ্গল’–এর রেখাগুলি সজারুর কাঁটার মতো তীক্ষ্ম হয়ে আমাদেরকে বিদ্ধ করে। আমরা রক্তাক্ত হই, নিজেদের খাবারের থালার দিকে তাকিয়ে লজ্জাবনত হতে শিখি।
এই ছিল তোমাদের নবম শ্রেণি ১৪তম সপ্তাহের চারু ও কারুকলা অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান– শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবিগুলাে বিখ্যাত হওয়ার কারণ।
৯ম শ্রেণির অন্যান্য এসাইনমেন্টের উত্তর-
[ninja_tables id=”11682″]আরো দেখুন-
সকল স্তরের শিক্ষা সংক্রান্ত সঠিক তথ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকুরি বিজ্ঞপ্তি, চাকুরির পরীক্ষা, এডমিট কার্ড, পরীক্ষার রুটিন, সরকারি বেসরকারি বৃত্তি, উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য সবার আগে পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজটি Follow করে রাখুন। ইউটিউবে সর্বশেষ আপডেট পেতে বাংলা নোটিশ ডট কম এর ইউটিউব চ্যানেলটি Subscribe করে রাখুন। আপনার প্রতিষ্ঠানের যেকোন বিজ্ঞপ্তি, খবর, নোটিশ ও জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়ে লেখা প্রকাশ করতে চাইলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।