সর্বশেষ আপটেড

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা

আজ আলোচনা করবো এইচএসসি ২০২১ ৬ষ্ঠ সপ্তাহ ইতিহাস ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট এর বাছাইকরা নমুনা উত্তর/ সমাধান। উক্ত আর্টিকেল পর্যালোচনা শেষে এইচএসসি ২০২১ পরীক্ষার্থীরা ৬ষ্ঠ সপ্তাহের ইতিহাস ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট এর উত্তর সম্পর্কে ভালো ধারণা পাবে এবং অ্যাসাইনমেন্টটি সুন্দরভাবে সমাধান করতে পারবে। অ্যাসাইনমেন্টের নির্ধারিত শিরোনাম- ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা

মূল উত্তর দেখার পূর্বে নির্ধারিত অ্যাসাইনমেন্ট ও তার ব্যাখ্যা দেখে নিই।

এইচএসসি ২০২১ ৬ষ্ঠ সপ্তাহ ইতিহাস অ্যাসাইনমেন্ট

এইচএসসি ২০২১ ৬ষ্ঠ সপ্তাহ ইতিহাস অ্যাসাইনমেন্ট

অ্যাসাইনমেন্ট: ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

নির্দেশনা (সংকেত/ধাপ/পরিধি):

১. প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে হবে।

২. ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে হবে।

৩. ফরাসি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ ব্যাখ্যা করতে হবে।

৪. ফরাসি জনজীবনে বিপ্লবের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে হবে।

৫. বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে।

এইচএসসি ২০২১ ৬ষ্ঠ সপ্তাহ ইতিহাস ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট এর বাছাইকরা নমুনা উত্তর/ সমাধান

ক) প্রাক বিপ্লব ও ফ্রান্সের সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাঃ

প্রাক-বিপ্লব ফ্রান্স

১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ফ্রান্সের জাতীয় সভার (স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করার ফলে ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব দেখা দেয় বলে মনে করা হয়। ফরাসি বিপ্লব কেবল ফ্রান্সের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, এ বিপ্লব সমগ্র ইউরোপের রূপান্তর ঘটায় । ঐতিহাসিক রবার্ট পামারের মতানুসারে ফরাসি বিপ্লবকে ইউরোপীয় বিপ্লব বলাই সংগত। ফ্রান্সে যা ঘটে তাকে ইউরোপীয় বিপ্লবের ফরাসি অধ্যায় বলা যেতে পারে। ফরাসি বিপ্লব কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বরং এই বিপ্লবকে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রস্তুত ঘটনা বলা যায়। আসলে ফরাসি বিপ্লব ছিল ইউরোপীয় ক্ষয়প্রাপ্ত সমাজব্যবস্থার পতনের স্বাক্ষর। এই পতন প্রথমে ফ্রান্সে দেখা দেয়, পরে ইউরোপেও তা প্রসারিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের সূচনা অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের অবস্থার মধ্যেই নিহিত ছিল।

সামাজিক অবস্থা

ফরাসি দেশের সমাজব্যবস্থা বিশেষ অধিকার ও অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ জন্য বলা হয়ে থাকে যে, “The Revolution of 1789 was much less rebellion against despotism than a rebellion against in equality.” (১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব ছিল স্বৈরাচারী শাসন অপেক্ষা অধিকতর বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ)।” অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় সমাজ বিশেষ করে ফ্রান্সে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, যথা— যাজক শ্রেণি, অভিজাত শ্রেণি এবং সাধারণ শ্রেণি। প্রতিটি শ্রেণিকে এস্টেট (Estate) বলা হতো। যাজক ও অভিজাত শ্রেণি ছিল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেট সাধারণ লোকেরা ছিল Third Estate বা তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু ভূমিকেই সম্পদের প্রধান উৎস বলে মনে করা হতো, সেহেতু ভূমির মালিকানাই সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের চাবিকাঠি ছিল।

যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় ভূমির মালিকানা ও নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। যাজক শ্রেণি দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা- উচ্চতর যাজক (Upper Clergy), অধস্তন যাজক (Lower Clergy) ফ্রান্সে যাজকের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার যাজকরা প্রার্থনা ও উপাসনা ছাড়া শিক্ষাদান, দরিদ্রসেবা, জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব বহন করতেন। গির্জার উচ্চ যাজক যথা– বিশপ শ্রেণি ছিল সাধারণত অভিজাত পরিবারের লোক গির্জার জমিদারির আয়, গির্জার বিভিন্ন উপস্বত্ব তারা ভোগ করত। সমাজে তাদের দারুণ প্রতিপত্তি ছিল। উচ্চ যাজকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং শাসনকার্যে অংশ নিতেন। ফরাসি মন্ত্রী নেকারের মতে, ফরাসি গির্জার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১৩ কোটি লিভর (ফরাসি পাউন্ড)। কিন্তু তারা আধ্যাত্মিক কোনো দায়িত্বই পালন করতেন না।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

অভিজাত শ্রেণি ছিল ইউরোপের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাবান ও সুবিধাভোগী শ্রেণি ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে অভিজাতদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। দেশের জনসংখ্যার ১ শতাংশ ছিল অভিজাত। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও এরা সমাজের সর্বাধিক প্রভাবশালী ছিল। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ফলে অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব হয়। অভিজাতরা ভূমি ও কৃষকদের উপর বহু অধিকার ভোগ করত। এরা বংশানুক্রমিকভাবে ভূমির উপর অধিকার ভোগ করত। অভিজাত শ্রেণি সরকারকে কর দেওয়ার ব্যাপারে বহু ছাড় ও সুবিধা ভোগ করত।

অভিজাতরা নানা প্রকার সামস্ত কর পেত ম্যানর প্রথা বা খামারপ্রথার ফলে অভিজাতরা ম্যানর থেকে নানাভাবে অর্থ পেত। এছাড়া তারা রাজার সভাসদ, সেনাপতি, উচ্চ কর্মচারী হিসেবে কাজ করার একচেটিয়া অধিকার ভোগ করত। এরা যুদ্ধবিগ্রহ, শাসনকার্য পরিচালনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাজার সহায়তা করত। মোটকথা, অষ্টাদশ শতক ছিল ইউরোপে অভিজাত বা সামন্ত শ্রেণির কর্তৃত্বের যুগ

তৃতীয় শ্রেণি বা Third Estate বলতে অভিজাত ও যাজক ছাড়া বাকি সকল লোককে বোঝাত। ধনী বুর্জোয়া যথা- শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক প্রমুখের অর্থকৌলীন্য থাকলেও জন্মকৌলীন্যের অভাবে তারা তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিল। ফরাসি দেশে ধনী বুর্জোয়াদের নাম ছিল haute bourgeois বা হুটে বুর্জোয়া। বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবী সম্প্রদায়, যথা— শিক্ষক, আইনজীবী, সাধারণ কর্মচারী প্রমুখও তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের মধ্যবিত্ত বা পাতি বুর্জোয়া বলা হতো। এই শ্রেণিও কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করত না। তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কৃষকরা।

কৃষক শ্রেণি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা- স্বাধীন কৃষক ও ভূমিদাস। ভূমিদাস শ্রেণি মালিককে বিভিন্ন কর দিত, যাজককে ধর্ম কর দিত, মালিকের জমিতে বেগার খাটত। এরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাত। তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার কিছুই ছিল না। কৃষক শ্রেণিই ছিল সমাজের সম্পদের উৎপাদনকারী। কিন্তু অভিজাত বুর্জোয়া ও শহরবাসীরা এদের হীন চোখে দেখত। তারা মনে করত যে, কৃষকরা ছিল নিরক্ষর কুৎসিত শ্রেণি। জমি চাষ করতে, কর দিতে ও উচ্চ শ্রেণির সেবা করতে কৃষকরা অনুগ্রহণ করেছে। কৃষকদের জীবন ছিল শোষিত, করভারে জর্জরিত এবং অভিজাতদের দ্বারা নির্যাতিত। ঐতিহাসিক C. D. Hazen এ প্রসঙ্গে বলেন, এ সমস্ত কর দেওয়ার ফলে কৃষকরা প্রায় অনাহারে থাকত।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই শ্রেণির প্রভাব ইউরোপের সকল দেশে সমান ছিল না। সামন্তপ্রথার ফলে ফ্রালে অভিজাতদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। অভিজাত শ্রেণি জন্মকৌলীন্যের জোরে সবকিছুই ভোগ করত। বুর্জোয়া শ্রেণি অর্থকৌলীন্যে বলীয়ান হলেও সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল না। পূর্ব ইউরোপে বুর্জোয়াদের সংখ্যা ছিল নামমাত্র অন্তঃশুল্ক, বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রতি সরকারি উদাসীনতা বুর্জোয়া শ্রেণিকে সামন্ত শাসনের প্রতি বিরূপ করে তোলে। বুর্জোয়ারা ছিল শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। এরা এজন্য পুরাতনতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারায় এবং বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। ঐতিহাসিক রাইকার ফরাসি বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ফরাসি বিপ্লব মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সাম্য লাভের আন্দোলনের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল।

গ্রামে ও শহরে এক শ্রেণির ভূমিহীন দিনমজুর ও শ্রমিক ছিল। এদের বাসগৃহ বা চাষের জমি বলতে কিছুই ছিল না। এরা অপরের জমিতে দিনমজুরি খাটত। শহরে এলে এরা কারখানার কাজ বা গৃহভৃত্যের কাজ করত। অভিজাতরা এই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণিকে সমাজের নিম্নশ্রেণি বলে গণ্য করত। এছাড়া ভিক্ষুক ও উপজীবিকাহীন লোকও এ যুগে দেখা যেত। ফ্রান্সের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ ছিল উপজীবিকাহীন লোক। বিপ্লবের সময় এরা প্যারিসের জনতার সাথে যোগ দিয়ে ধ্বংসকারী মূর্তি ধারণ করে নেপোলিয়নের মতে, “ফরাসি বিপ্লব সুবিধা ভোগকারী এবং ক্ষমতালিন্দু শ্রেণির বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত জাতীয় গণ আন্দোলন।”

অর্থনৈতিক অবস্থা

অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের অর্থনীতি একটি পরিবর্তনমুখী অবস্থায় উপনীত হয়। মধ্যযুগের শেষ দিক থেকে কৃষির পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য ও উপনিবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যদিও অষ্টাদশ শতকে কৃষিই ছিল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, তবু শিল্প, বাণিজ্য ও মূলধন নিয়মিতভাবে বেড়ে পুরাতন সমাজের চরিত্রে পরিবর্তনের সূচনা করে। অর্থনীতিতে কৃষিরই ছিল অগ্রাধিকার।

সমাজে মর্যাদালাভের প্রধান উপায় ছিল ভূসম্পত্তির মালিকানা। এমনকি বণিকরা বাণিজ্যে ভালো অর্থ রোজগার করার পর সে অর্থে জমি কিনে জমির মালিকানাকে তাদের আয় ও সম্মান লাভের পথ মনে করত। বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষাবাদের ব্যবস্থা তেমন ছিল না। দরিদ্র ও নিরক্ষর কৃষকরা এসব বিষয় বুঝত না লেফেভারের মতে, কৃষকরা বৃষ্টি ও প্রকৃতির দয়ার উপর নির্ভর করে কৃষিকাজ করত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে কৃষকের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকত না। জমিগুলো পালাক্রমে আবাদ করে এর উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করা হতো না।

মার্কান্টাইল মতবাদ বা সংরক্ষণবাদ অনুযায়ী খাদ্যশস্য দেশের বাইরে রপ্তানি করা নিষিদ্ধ ছিল। খাদ্যশস্য রপ্তানি ও অবাধ বিক্রি নিষিদ্ধ থাকায় খাদ্যদ্রব্যের ন্যায্য দাম পাওয়া যেত না। সরকার মনে করত, কৃষকরা উদ্বৃত্ত খাদ্য চালান দিলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। আলোচিত রাজা লর্ড অ্যাক্টদের মতে, “মার্কান্টাইলবাদ ছিল আলোচিত স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ বা অনুপূরক অর্থনৈতিক মতবাদ।” মার্কান্টাইলবাদীরা বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। সুতরাং বিদেশি মাল অবাধে আমদানি করলে বা খাদ্যদ্রব্য অবাধে রপ্তানি করলে সম্পদ ক্ষয় পাবে। ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চলত না। সেজন্য আমদানি মালের উপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হতো।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

মার্কান্টাইল বা সংরক্ষণবাদের বিরুদ্ধে ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats) নামক অর্থনীতিবিদরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। অবাধ বাণিজ্যবাদীরা একথা বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, বিশ্বে সম্পদের সীমা নেই। যতই খাদ্য ও শিল্পবস্তুর উৎপাদন বাড়বে ততই সম্পদ বাড়বে। এজন্য তারা শিল্প-বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ লোপ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের দাবি জানান। মার্কাস্টাইলবাদজনিত সংরক্ষণনীতির ফলে বাণিজ্যমন্দা এবং দারিদ্র্য বাড়ছে, একথা বোঝাতে তারা চেষ্টা করেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে | ফিজিওক্র্যাটদের তীব্র সমালোচনার ফলে সংরক্ষণবাদের তীব্রতা কিছুটা কমে যায়। তবু ইউরোপীয় শাসকদের চিন্তা মার্কান্টাইলবাদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি।

ইউরোপের সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো অষ্টাদশ শতকের উপনিবেশের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপনের চেষ্টা চালায়। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন এ বিষয়ে কৃতিত্ব দেখায়। ভারত ও উত্তর আমেরিকায় উপনিবেশ দখলের জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ১৭৪০-৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দেয়। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি | বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে শতকরা ৪০ ভাগ বাণিজ্য উপনিবেশের সাথে চলত।

উপনিবেশের সম্পদ ও দক্ষিণ আমেরিকার সোনা, রুপা আমদানির ফলে ইউরোপের এক শ্রেণির বণিকের হাতে প্রভূত সম্পদ জমা হয়। এরা মূলধনী বা ক্যাপিটালিস্ট (Capitalist) শ্রেণিতে পরিণত হয়। এই শ্রেণি তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারকে সুদে ধার দিত। বাকি অর্থ শিল্পে ও ব্যাংকে লগ্নি করত। এদের মূলধনের সাহায্যে লন্ডনের বেরিং (Baring), আমস্টারডামের হোপ (Hope), ফ্রান্সের সুইস (Swiss) ব্যাংক প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যাংক চালু হয়। মোটকথা, অষ্টাদশ শতকে কৃষির কথা বাদ দিলে শিল্প-বাণিজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া দেখা যায়। বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল পরিবর্তনের অগ্রদূত। এই পরিবর্তনের চাপে পুরাতন কৃষিকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ধ্বংসের পথ পরিষ্কার হয়। ফরাসি বিপ্লব ছিল তারই প্রকাশ।

রাজনৈতিক অবস্থা

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সসহ ইউরোপে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। এ সম্পর্কে সি. ডি. এম. কেটেলবির মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, “অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ গণতান্ত্রিক কিংবা জাতীয়তাবাদী কোনোটাই ছিল না, আসলে সেগুলো ছিল রাজবংশসদ্ভূত এবং রাজ্যকে রাজার ব্যক্তিগত কিংবা রাজবংশের সম্পত্তি বলে মনে করা হতো।” রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা। রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজ্য বিস্তারকে জাতির শক্তি ও মর্যাদার চিহ্ন বলে ধরা হতো। রাজা স্বর্গীয় অধিকার নীতি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি দাবি করতেন যে, তার কাজের জন্য তিনি একমাত্র ঈশ্বরের নিকট দায়ী।

পার্থিব কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ অনুযায়ী তিনি চলবেন না। এভাবে রাজার স্বর্গীয় অধিকার তত্ত্ব মধ্যযুগের শেষ দিকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ মতবাদের আশ্রয় নিয়ে রাজারা যারপরনাই স্বৈরাচারী হন। ফ্রান্সের বুরবো রাজবংশ ছিল রাজকীয় স্বৈরাচারী ক্ষমতার প্রকৃষ্ট নিদর্শন ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই ঘোষণা করেন যে, ‘আমিই রাষ্ট্র’ রাজশক্তিগুলো বংশানুক্রমিকভাবে শাসন করত। ইউরোপের জনসাধারণের বা প্রজাদের স্বাধীনতা বলে কিছুই ছিল না। অধিকাংশ দেশের শাসনব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী। জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার ছিল না। রাজা, অভিজাত ও ধর্মযাজকরা একযোগে জনসাধারণকে শাসন করতেন। ন্যায়বিচার বা আইনের শাসন ছিল না। কারণ বিচারব্যবস্থা রাজার হুকুমেই চলত। ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন অযোগ্য ও অকর্মণ্য। দেশ শাসন করার নৈতিক অধিকার তিনি হারিয়ে ফেলেন।

খ) ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান

যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিতে সবকিছু বিচার করার মানসিকতাই ছিল জ্ঞানদীপ্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য। অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল আধুনিক ইতিহাসে জ্ঞানদীপ্তির যুগ। রেনেসাপ্রসূত অনুসন্ধিৎসা ও সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি উক্ত শতাব্দীতে কার্যকর ছিল। জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে উদ্দীপ্ত এক শ্রেণির পণ্ডিত ফ্রান্সের পূর্বতন শাসনামলের তীব্র সমালোচনা করে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তম্ভগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে মন্টেস্থ, ভলতেয়ার, রুশো, দিদারো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

অনেকের মতে, বিপ্লবে দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি বা অংশগ্রহণ করেননি। তবে স্বীকার করতে হবে যে, দার্শনিকদের প্রকৃত কার্যের ক্ষেত্র ছিল মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ভাব-জগতে নতুন ভাবধারার সৃষ্টি করা। অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নীতিগত অধিকার সম্পর্কে তারা জনগণকে সচেতন করেন এবং অবহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে এখানেই দার্শনিকদের অবদান।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

মন্টেঙ্কু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দ): ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন মন্টে। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে বিপ্লব বিমুখ এবং রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রে তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক। তিনি তার যুক্তিবাদী মনন দ্বারা ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজ ও শাসনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করেন। তিনি ছিলেন ক্যাথলিক গির্জার ও রাজার সীমাহীন ক্ষমতার ঘোরবিরোধী ‘স্বর্গীয় অধিকারপ্রাপ্ত রাজতন্ত্র’ তত্ত্বকে অস্বীকার করে তিনি এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরেন। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ (The spirit of laws-1748) এবং ‘দ্য পারসিয়ান লেটারস্‌’ (The Persian Letters) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তিনি ‘Persian Letters’ নামক ব্যঙ্গাত্মক লেখার মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজের অন্যায় শ্রেণিবৈষম্যের প্রতি কটাক্ষপাত করেন এবং The spirit of laws’ গ্রন্থে তিনি শাসনব্যবস্থার মধ্যে আইন বিভাগ, কার্যনির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ- এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলেছেন। কারণ তার ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব মতে, এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতার একত্রীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও লোপ পায়। সুতরাং মন্টেভুর রচনা জনগণকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল। তিনি স্বৈরতন্ত্রের যে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করেন এবং বিকল্প হিসেবে ক্ষমতা বিভাজনের যে প্রস্তাব দেন তা সমকালীন যুগে গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মন্টেঙ্কু ফরাসি বিপ্লব দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তার লেখনী ফরাসি জনতার মননে ব্যাপক প্রতিঘাত সৃষ্টি করেছিল। এজন্য ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব-পরবর্তী সংবিধানে তার ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করা হয়।

ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ):

ভলতেয়ার ছিলেন ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাবান। তার প্রকৃত নাম ফ্রাঁসোয়া ম্যারি অ্যারাউয়ো তিনি নাটক, কাব্য, ইতিহাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। তার লেখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে Oedipe, Letters Philosophiques Elements of Essays on Universal History এবং Zodig” তার লেখার লক্ষ্য ছিল চার্চের দোষ-ত্রুটি এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা। তিনি আপসহীনভাবে সামন্তপ্রথা ও খ্রিষ্টানধর্মের গোঁড়ামিবিরোধী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এক দার্শনিক। তাকে মানবজাতির ‘বিবেক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি প্রচলিত রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মনীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেন। তিনি গির্জার দুর্নীতি ব্যঙ্গাত্মক লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করলে গির্জার প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও ভীতি কমে যায়। তার বিখ্যাত উক্তি হলো, “ঈশ্বর না থাকলে তাকে বানাতে হতো। কেননা, প্রকৃতি বলছে ঈশ্বর আছে।”

রুশো (১৭১২-১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ):

বিপ্লবের প্রেরণা সৃষ্টিতে রুশোর অবদানও কিন্তু কম ছিল না। তিনি ফ্রান্সে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেন। সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল তার আদর্শ। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে New Heloisic Confession, Emile ও Social Contract” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বিখ্যাত সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (Social Contract-1762) গ্রন্থ দ্বারা শাসনক্ষেত্রে জনমত তথা জনগণই সার্বভৌম এই মতবাদ প্রচার করেন। ‘মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু মানুষ সর্বত্রই শৃঙ্খলবদ্ধ’- রুশোর এই মতবাদ বিপ্লবীদের কল্পনার আগুনে ফুলকি ধরিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে রুশো ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অগ্রদূত রুশো তার বিখ্যাত রচনায় এ যত্য প্রচার করেন যে, ঈশ্বর রাজা বা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেননি। আদিতে সব মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ও সুখী ছিল। জনসাধারণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস। সুতরাং রাজা জনসাধারণের মতানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তার এ তত্ত্ব ইউরোপীয় চিন্তাজগতে এক বৈপ্লবিক চেতনার জন্ম দেয়। এ কারণে রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্রগুরু বলা হয়ে থাকে।

ডেনিস দিদারো (Denis Diderot):

বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন ডেনিস দিদারো। তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষ রচনা করে ফ্রান্সে যুক্তিবাদী দৃষ্টি গঠনে সহায়তা করেছিলেন। এই গ্রন্থে মানুষের জ্ঞাতব্য সবকিছুই সন্নিবেশিত করা হয়েছিল এবং তদানীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনাও এ গ্রন্থে লিখিত হয়েছিল। মানুষের জন্মগত অধিকার, মানবধর্ম, শিক্ষা বিষয়ে তথ্যপূর্ণ লেখা ছিল এ গ্রন্থে, যা বঞ্চিত মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে উজ্জীবিত করে।

এভাবে দেখা যায় যে, বিভিন্ন পণ্ডিত, জ্ঞানী দার্শনিকদের লেখনীর মাধ্যমে ফরাসি জনগণের মন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। তবু ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা গবেষকগণ একমত নন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ফরাসি বিপ্লব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই সংঘটিত হয়েছিল, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক কারণে নয়। এই বিতর্কের গভীরে না গিয়েও বলা যায় যে, দার্শনিকদের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই বিপ্লবকে উৎসাহিত করেছিল। কারণ দার্শনিকগণ তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দোষ-ত্রুটির প্রতি ফরাসি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক বিরাট জাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা এভাবে পূর্বতন শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন, ফলে বিপ্লব সম্ভবপর হয়েছিল। একথা মানতে হবে যে, দার্শনিকদের সমালোচনা ও যুক্তিবাদী রচনা ফরাসি জনগণকে বিপ্লব সংঘটনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিল। সুতরাং ফরাসি বিপ্লবে মহান দার্শনিকদের প্রভাব ও অবদান ছিল অপরিসীম ও অনস্বীকার্য।

সমালোচনা

ফরাসি বিপ্লবের কারণগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। ঐতিহাসিক ফিসারের মতে, “ফরাসি রাজতন্ত্র সমাজের ঊর্ধ্বতন সম্প্রদায়ের বিশেষ অধিকার সমাধান করতে পারেনি বলে বিপ্লব ঘটেছিল। সামন্তপ্রথার দোষ-ত্রুটি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর ন্যায় ফ্রান্সের জাতীয় জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। ফরাসি রাজশক্তি এসব দোষ-ত্রুটি দূর করতে সক্ষম হয়নি।” ঐতিহাসিক মন্টেগু বলেন, “কৃষকদের দুরবস্থাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ।”

জে. হল্যান্ড রুজের মতে, “ফরাসি দার্শনিকদের রচনার প্রভাবে জনমনে যে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল তাতে ফরাসি বিপ্লবের সৃষ্টি হয়।” মর্স স্টিফেনের মতে, “এ বিপ্লবের প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দার্শনিক বা সামাজিক নয়। ১৭ ঐতিহাসিকদের উপর্যুক্ত মতামতগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, ফরাসি বিপ্লব কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে সংঘটিত হয়নি। প্রত্যেকটি কারণেরই এক-একটি বিশেষ প্রভাব ছিল। বিভিন্ন কারণের গুরুত্বে পার্থক্য থাকলেও সবগুলো কারণের সমষ্টিগত ফল হিসেবে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ঘটেছিল। তবে এটা সত্য যে, অন্য কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি ফরাসি বিপ্লব সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল।

ফরাসি বিপ্লবের স্রষ্টা

এটি সর্বজনবিদিত যে, ফরাসি বিপ্লব তৃতীয় সম্প্রদায়েরই সৃষ্টি। কিন্তু তৃতীয় সম্প্রদায় একটি বিশেষ একক শ্রেণি ছিল না, এটি কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বিপ্লবের সূচনা করেছিল কারা? এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ লক্ষ করা যায়। কতিপয় ঐতিহাসিক নির্যাতিত কৃষক শ্রেণিকে ফরাসি বিপ্লবের স্রষ্টা বলে অভিমত দেন। আবার কতিপয় ঐতিহাসিক মনে করেন বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল ফরাসি বিপ্লবের সূচনাকারী। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিপ্লব ঘটানোর মতো যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি বা যোগ্যতা কৃষকদের ছিল না। বরং বুর্জোয়ারা ছিল শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী। তারা যথেষ্ট বিত্তবান হলেও সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তাই সামাজিক মর্যাদা লাভের প্রত্যাশায় মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণি বিপ্লবের স্রষ্টা, কৃষকরা তাদের অভিযোগ ও সমস্যা থেকে উত্তরণের আশায় বুর্জোয়াদের অনুসরণ করেছিল মাত্র।

গ) ফরাসি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা 

অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাজার প্রয়ােজন হয়ে পড়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের। সেই অর্থ পেতে হলে কর ধার্য করা ব্যতীত রাজার কাছে অন্য কোনাে পথ খােলা ছিল না। অর্থ সচিব নেকার রাজাকে স্টেইস- জেনারেলের অধিবেশন ডেকে কর আদায়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন। সুযােগ বুঝে তৃতীয় সম্প্রদায় তাদের সদস্য সংখ্যা যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান করার দাবি জানালে ১৭৮৮-এর ডিসেম্বরে রাজা তা মেনে নিতে বাধ্য হন।

১৭৮৯ – এর ৫ মে স্টেটস – জেনারেলের অধিবেশন ডাকা হয়। ১৭৫ বছর পর ফ্রান্সে এই সংসদ ভার্সাই নগরীতে নতুন করে শুরু করার ঘােষণা দেয়া হয়। এতে যাজক সম্প্রদায়ের ৩০০, অভিজাতদের ৩০০ এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের একা ৬০০ প্রতিনিধি থাকার বিধান স্বীকৃত হয়। এপ্রিলের শেষ দিকে স্টেটস – জেনারেলের নির্বাচনে যাজকদের জন্য নির্ধারিত ৩০০ জনের মধ্যে ২৯১ জন, অভিজাতদের ৩০০ জনের মধ্যে ২৭০ জন এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের ৬০০ জনের মধ্যে ৫৭৮ জন সদস্য নির্বাচিত হলে মােট ১১৩৯ জন সদস্য উক্ত অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

মৃত্যুবরণ,দাঙ্গাহাঙ্গামা ও অন্যান্য কারণে বাকি ৬১ টি আসনের প্রতিনিধি উক্ত সময়ে নির্বাচিত হতে পারেননি। রাজা এবং অর্থসচিব মেকার উভয়েই স্টেটস-জেনারেলের কাছে কর আদায়ের প্রস্তাব রাখেন। সংসদে তৃতীয় সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাজা শুধু ধর্ম যাজক এবং অভিজাত প্রতিনিধিদের সাথেই মিলিত হলে তৃতীয় সম্প্রদায় অপমানিত বােধ করেন। ১৭ জুন তাঁরা নিজেদেরকে সমগ্র জনগণের প্রতিনিধি এবং স্টেটস – জেনারেলকে জাতীয় সভা’ বলে ঘােষণা করে।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

এ নিয়ে রাজা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে বিরােধ বাড়তে থাকে। ২০ জুন প্রতিনিধি সভাকক্ষে ঢুকতে না পেরে টেনিস কোর্টে সমবেত হয়ে একটি শপথ গ্রহণ করেন। উক্ত শপথে বলা ছিল যে, যতদিন টেনিস কোর্ট একৰ্তি সংবিধান রচিত না হবে ততদিন তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা একত্রে থাকবে। এ শপথকে টেনিস কোর্টের শপথ” বলা হয়ে থাকে। ইতােমধ্যে যাজক ও অভিজাত প্রতিনিধিদের একটি অংশ নৈতিকভাবে তৃতীয় সম্প্রদায়ের শপথকে সমর্থন প্রদান করেন। রাজা অবস্থা বেগতিক দেখে কিছু কিছু শর্ত মেনে নিলেও যড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকেন। ১২ জুলাই রাজা অর্থসচিব | মেকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এতে প্যারিতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

ইতােমধ্যে প্যারিতে পৌরসভা কমিউন) এবং জাতীয় রক্ষিবাহিনী তথা National Guard তৈরি করা হয়। প্যারির মেয়র নিযুক্ত হলেন বেইলি (Baily} এবং রক্ষীবাহিনীর অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হলেন লাফায়েত রাজা বাধ্য হলেন এসব নিযুক্তি মেনে নিতে।
ফলে প্যারির প্রশাসনিক দায়িত্ব বুর্জোয়া তথা তৃতীয় সম্প্রদায়ের হাতে চলে যায়। প্যারিতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে রাজা বিদেশি সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় প্যারির ওপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছেন। ১৪ জুলাই তাই উত্তেজিত জনতা সকাল বেলা বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে যাত্রা করে। শহরের কতগুলাে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলের সশস্ত্রভাবে জন বাস্তিল দুর্গ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বিকেল চারটায় বাস্তিল দুর্গের পতন হয়। রাজাকে প্যারি এ০০.বাস্তিল দুর্গ। ঘটনাবলি এবং বাস্তিল দুর্গ বিপ্লবীদের হস্তগত হওয়ার সংবাদ অবগত করা হলে তিনি স্বগত উচ্চারণ করেন “ এটা বােধ হয় হাঙ্গামা”।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

পাশেই দণ্ডায়মান সভাসদ বললেন, “M ais. C’est une revolt Non. Sire, Cest une evolution” “না, রাজা মহাশয়, বিদ্রোহ নয়, মহাশয় এ হচ্ছে বিপ্লব।” প্রকৃতপক্ষে, ফ্রান্সে বাস্তিল দুর্গ পতনের পর থেকে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তা দ্রুতই সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, শিক্ষা – সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ফ্রান্সে ৪ আগস্টের।

কৃষি বিপ্লবের পর থেকে সামন্ত ব্যবস্থার জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সাধন, ২৬ আগস্ট ১৭৮১৯-এ গৃহীত মানবাধিকার ঘােষণাপত্র (Declaration of the Rights of Man and of the citizen} -এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান এবং ১৭৮৯ থেকে ১৭৯১ পর্যন্ত সময় জাতীয় সংবিধান পরিষদের কার্যাবলি রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে দুর্বল করতে থাকে।

ফ্রান্স এভাবেই বিপ্লবের এক নতুন পথ রচনা করে। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত সময়ে ফরাসি বিপ্লব অনেক ধরনের কার্য সাধন ও বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে চলছিল।

ঘ) ফরাসি জনজীবনে বিপ্লবের প্রভাব;

ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল : ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। বিপ্লবের আগে ফ্রান্স ছিল একটি সামন্ততান্ত্রিক দেশ। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা পুঁজিবাদী ধারায় বিকশিত হতে থাকে। ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও ধর্মযাজকগােষ্ঠীর প্রভাব দুর্বল হতে থাকে। ফ্রান্স কার্যত একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার সুযােগ লাভ করে বিপ্লবের মাধ্যমে।

ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করেছে, বিভিন্ন নামে ফ্রান্সে জাতীয় সংসদ গঠন করেছে, ফ্রান্সকে প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে বেশ কিছু সংস্কারের মাধ্যমে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে অবদান রেখেছে। এই বিপ্লব ফরাসি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার করেছে। ফ্রান্সে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটার সুযােগও এ বিপ্লবের ফলে শুরু হয়। জিবভিন, জ্যাকোবিনসহ বিভিন্ন গােষ্ঠী ফ্রান্সে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফরাসি বিপ্লব ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্সের সমাজকেই নয়, গােটা ইউরােপকেও আলােড়িত করেছিল।

গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাম্য, শােষণমুক্তি, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি ধারণা ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী ইউরােপের রাষ্ট্রসমূহে বিস্তার লাভ করে। তাই ১৭৮৯ সালের বিপ্লবকে আধুনিক ইউরােপের নতুন পর্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ফরাসি বিপ্লব রাতারাতি সব পরিবর্তন নিয়ে আসে নি। অনেক ভুল-ভ্রান্তি ও বিচ্যুতির পরও ফ্রান্সের জনগণ বিপ্লবের আদর্শকে ত্যাগ করেনি।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা।

বিপ্লবের পথে ফ্রান্সে অনেক রক্ত ঝরেছে, দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, বিপ্লবকে ধ্বংস করার চেষ্টাও হয়েছে, প্রতিবিপ্লবী শক্তি ফ্রান্সের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ফ্রান্সের জনগণ তারপরও বিপ্লবের আদর্শের কাছে ফিরে যাওয়ার আকাঙক্ষা থেকে ১৮৩০ ও ১৮৪৮ সালে পর পর দুটি বিপ্লব সংঘটিত করেছে।

১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন গঠিত হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের চেতনা থেকে। ফ্রান্স বিপ্লবের আদর্শকে ত্যাগ করেনি, বরং এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বার বার বিপ্লব সংঘঠিত করেছে। ফরাসি সমাজ বিপ্লবের আদর্শকে এখনও ত্যাগ করেনি। ফ্রান্সে। এখনও বিপ্লবের সকল নায়ক, নেতা-কর্মীকে শ্রদ্ধা করা হয়। ফ্রান্সের অনেক রাস্তাঘাট ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে বিপ্লবীদের নামে। ফ্রান্সের তদনান্তিন কিনােলগল করাসি বিপ্লবের সৈনিকদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তাঁদের ছবি বহন করে। ফচবাসি জাতি প্রতি বছরই ১৪ জুলাইকে তাদের প্রধান জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এর মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের চেতনায় তারা উজ্জীবিত হওয়ার শপথ নতুন করে গ্রহণ করে থাকে।

ফরাসি বিপ্লব এভাবেই ফরাসি জাতির কাছে মহান এক ঐতিহাসিক কালপর্ব হিসেবে সমাদৃত হয়েছে পৃথিবীর সব দেশেই ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পঠিত হয়। এই বিপ্লবের ইতিহাস পাঠে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলিত হয়, নিজ নিজ দেশের বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। ফরাসি বিপ্লবের দেশীয় ও আন্তজার্তিক তাৎপর্য এখানেই নিহিত রয়েছে।

ঙ) বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবঃ

নিচে কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু উল্লেখ করা হলোঃ

ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব

ফ্রান্সের এই সম্মিলিত বিপ্লব এর প্রভাবে যে সমস্ত ফলাফল গুলি দেখা যায় তা হলো – 

প্রজাতন্ত্র : 

       1789 সালে যে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল তার ফলে 1789 সালের 26 এ আগস্ট রাজতন্ত্রের অধিকার নষ্ট করে ব্যাক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণা করা হয়। এই ঘটনার জন্য 1792 সালে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান হয় ও প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। European history

প্রজার অধিকার :

       ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের অবসান হয়। ফরাসিরা তাদের অধিকার লাভ করে। ব্যাক্তি স্বাধীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, সমিতি গঠনের অধিকার এবং ভোটার অধিকার লাভ করে ফ্রান্সের প্রজারা। European history.

সামন্ততন্ত্রের ধ্বংস :

           1789 সালের ফরাসি বিপ্লবের ফলে ইউরোপের সামন্ত তন্ত্রের অবসান ঘটে। সরকারি চাকরি, ব্যাক্তি স্বাধীনতা ফিরে আসে ও সামন্ত তান্ত্রিক সমস্ত কর বাতিল করা হয়।

ত্রয়ী আদর্শ :

           ফরাসি বিপ্লবের মূল তিনটি আদর্শ ছিল – সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে সামাজিক সাম্য, জনগণের মিত্রতা, এবং বিভেদহীন স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা হয়।

ভোগবাদী অর্থনীতি :

          ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণীর মানুষের ফলে ফরাসি বিপ্লবের দানা বাধে কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই বুর্জোয়া শ্রেনীর মানুষরায় সব থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করতে থাকে। এর ফলে দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকশিত হয়।

আদর্শ সাম্যবাদ :

       বর্তমান কালে কোনো বিপ্লবের পিছনে যে সাম্যবাদ কাজ করে ঐতিহাসিক দের মতে এই সাম্যবাদের উৎস হলো ফরাসি বিপ্লবের সাম্য ও সমাজতান্ত্রিক ধারণা। European history.

সুশাসন :

        ফরাসি বিপ্লবের কারণে রাজতন্ত্রের অবসান হলে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। প্রজাতন্ত্র কে সুগঠিত করতে দেশের সর্বত্র একই আইন চালু করা হয়। যার ফলে ফ্রান্সে সুশাসন এর প্রতিষ্টা পায়।

শিক্ষার অগ্রগতি :

       ফরাসি বিপ্লবের ফলে রাজতান্ত্রিক/পোপতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা শেষ হয়। সর্ব সাধারণের জন্য শুরু হয় শিক্ষা। একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে জাকবিনরা ফ্রান্সের শিক্ষাকে প্রসারের বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলো।

বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব

নিঃসন্দেহে ফরাসি বিপ্লব ছিল ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সর্বজনীন বিপ্লব এর প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর প্রভাবে আন্দোলিত হয় ইউরোপসহ সারা বিশ্ব বিপ্লব শুরুর সময় ইউরোপের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিপ্লবকে স্বাগত জানায়। কিন্তু বিপ্লবোত্তর এর আবর্ত ও গতি বাড়তে থাকলে এর প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা আসে। তবে নেপোলিয়নের শাসনামল এবং পরবর্তী সময়েও বিপ্লবের প্রভাব ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিদ্যমান ছিল। ইউরোপব্যাপী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে ইউরোপের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে যুদ্ধের পথ উন্মুক্ত হয়। ইউরোপীয়

শক্তিবর্গের সাথে ফ্রান্সের যুদ্ধ সৃষ্টির প্রকৃত কারণ হলো-

  • ১। ফরাসি বিপ্লবের আবর্ত বৃদ্ধি ও বিপ্লবের গতির বহির্মুখিতা;
  • ২। ইউরোপীয় রক্ষণশীল রাজন্যবর্গের বিপ্লবভীতি। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই ও রানি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এতে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি রাজতান্ত্রিক দেশের রাজন্যবর্গের মধ্যে বিপ্লবভীতির সঞ্চার হয়। ফ্রান্সের বিপ্লবী ভাবধারা থেকে নিজ নিজ দেশকে রক্ষার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রজোট গঠন করে।
  • ৩। ফ্রান্স এভিগনন’ দখল করলে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে ফ্রান্সের পররাজ্য গ্রাসের নীতি সম্পর্কিত উদ্বেগের সঞ্চার হয় এবং
  • ৪। ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্রান্সের রাজ্যাংশ দখলের উদ্যোগ নেয়। অপরদিকে ফ্রান্স ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ থেকে ফ্রান্সকে রক্ষার এবং বিপ্লবের প্রভাব সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে যুদ্ধে জড়ায়।
    প্রথম দিকে ফ্রান্স শুধু বিপ্লবকে রক্ষার জন্যই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ আক্রমণাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে বেশি সময় লাগল না। আক্রমণাত্মক যুদ্ধের সাথে জাতীয়তাবোধের সংমিশ্রণ থাকায় বিপ্লবী যুদ্ধ সর্বগ্রাসী যুদ্ধে পরিণত হলো।

ক. ইংল্যান্ডে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব :

ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী প্রথম দিকে ব্রিটিশদের মনে তুমুল আনন্দোচ্ছ্বাস জাগিয়েছিল। ফ্রান্সের বুরবো রাজবংশের পতনে চিরশত্রু ইংল্যান্ড সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পিটের প্রত্যাশা ছিল ফ্রান্সে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে উভয় দেশের বৈরিতা দূর হবে। ব্রিটিশ প্রশাসনের ধারণা ছিল, ফরাসি বিপ্লব একান্তই স্থানীয় ঘটনা, ইংল্যান্ড পর্যন্ত এর প্রভাব প্রসারিত হবে না। কিন্তু অচিরেই ইংল্যান্ডের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

ইংল্যান্ডস্থ ফরাসি বিপ্লবের অনুসারীরা ফ্রান্সের অনুকরণে বিভিন্ন ক্লাব গঠন করতে শুরু করে। বিপ্লবের সর্বনাশা গতিধারায় ইংল্যান্ড সংক্রমিত হয়। বিপ্লবের বাড়াবাড়ি ও হিংসার ব্যাপকতা ব্রিটিশদের মনোভাবকে কঠোর করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্রিটেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা হ্রাস করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে ইংল্যান্ড মুক্ত থাকতে পারেনি। ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে এবং ব্যাপ্টিস্ট আন্দোলনে ফরাসি বিপ্লব প্রেরণা জোগায়।

খ. প্রুশিয়ায় (জার্মানিতে) প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব :

প্রুশিয়া ছিল বহু রাজ্যে বিভক্ত একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। বিপ্লবের গতিধারা যাতে রক্ষণশীল প্রুশিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রুশিয়া প্রথমে রাষ্ট্রজোটের সদস্য হয়। বুরবো রাজবংশকে রক্ষার অভিপ্রায় নিয়ে বিপ্লবী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। প্রুশিয়া-অস্ট্রিয়া স্বার্থ সংঘাতের সুযোগ নিয়ে ফ্রান্স অবশেষে যুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলস্বরূপ প্রুশিয়া রাষ্ট্রজোট ত্যাগ করে এবং ওয়ার্টিগনিস থেকে বিতাড়িত হয়। জার্মানির উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ফরাসি বিপ্লবের প্রতি সহনশীল ছিলেন। তাদের সমর্থন নিয়ে জার্মানির স্বৈরাচার শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়, যা ছিল ফরাসি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব।

গ. অস্ট্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব :

অস্ট্রিয়াও ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়। অস্ট্রিয়ারাজ লিওপোল্ড ছিলেন ষোড়শ লুইয়ের ঘোর সমর্থক। বুরবো রাজবংশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্যাড়ুয়া নামক স্থানে এক প্রচারপত্র প্রকাশ করলেন। এ প্রচারপত্রে তিনি ষোড়শ লুইয়ের সমস্যাকে নিজেদের সমস্যা বলে মনে করতে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ করেন। তিনি ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ফরাসি রাজতন্ত্রকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে লিওপোল্ড ও প্রুশিয়ারাজ ফ্রেডারিক পিলনিজের’ ঘোষণা প্রচার করলেন। এতে ঘোষণা করলেন যে, বিপ্লবী ফ্রান্সের পরিস্থিতি ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের চিন্তার বিষয়। ইউরোপীয় অপরাপর রাজন্যবর্গের সাহায্য পাওয়া মাত্রই অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া ফ্রান্সের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এ ভীতি প্রদর্শনের পরও ফ্রান্স ভয় পেল না। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফ্রান্স অস্ট্রিয়াকে স্যাভয় থেকে উৎখাত করে স্যাডয়ের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়।

এভাবে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে যখন ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, তখন ফ্রান্স ডাচদের নদী সেল্ডকে সর্বজনীন নদীপথ বলে ঘোষণা করল। এতে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের স্বার্থহানি ঘটল। পূর্ব থেকেই অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। নতুন করে স্পেন, হল্যান্ড ও সার্দিনিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। যুদ্ধের প্রথম দিকে ফ্রান্স পর্যুদস্ত হলেও পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ায় স্পেন রাষ্ট্রজোট ত্যাগে বাধ্য হয় এবং পিরনিজ পর্বতের ওপারে আশ্রয় নেয়। বেলজিয়াম ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং হল্যান্ড ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।

কাজেই দেখা যায়, ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ছিল যুদ্ধংদেহী ও বহুমুখী এবং প্রভাব ছিল ব্যাপক। কোনো বিপ্লবের বিপ্লবী ভাবধারা ও গতি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। ইউরোপব্যাপী এর মিশ্র ও তুমুল প্রতিক্রিয়াই এর প্রমাণ।

এটিই তোমাদের এইচএসসি ২০২১ ৬ষ্ঠ সপ্তাহ ইতিহাস ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট এর বাছাইকরা নমুনা উত্তর/ সমাধান- ফরাসি বিপ্লব সংঘটনে দার্শনিকগণের ভূমিকা

আরা দেখুন-

প্রতি সপ্তাহে সকল স্তরের অ্যাসাইনমেন্ট সংক্রান্ত সকল তথ্য পাওয়ার জন্য বাংলা নোটিশ এর ফেসবুক পেজটি লাইক এবং ফলো করে রাখুন ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন এবং প্লেস্টোর থেকে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড করে রাখুন।

আনসার আহাম্মদ ভূঁইয়া

বাংলাদেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা নোটিশ ডট কম এর প্রকাশক ও সম্পাদক জনাব আনসার আহাম্মদ ভূঁইয়া। জন্ম ১৯৯৩ সালের ২০ নভেম্বর, কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায়। বাবা আবদুল গফুর ভূঁইয়া এবং মা রহিমা বেগম। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে আবদুল্লাহ আল আরিয়ান বয়স ৫ বছর। মেয়ে ফাবিহা জান্নাত বয়স ১ বছর। আনসার আহাম্মদ ভূঁইয়া এর শিক্ষাজীবন আনসার আহাম্মদ ভূঁইয়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৮ সালে ম্যানেজমেন্ট এ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি উত্তরা ইউনিভার্সিটি ঢাকা থেকে বিপিএড সম্পন্ন করেন। আজিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ লাকসাম উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কিছুদিন ক্লাস করার পর। পারিবারিক কারণে নাঙ্গলকোট হাসান মেমোরিয়াল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। শিক্ষা জীবনে তিনি কুমিল্লা সরকারি কলেজ এ কিছুদিন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করার পর ভালো না লাগায় পুনরায় ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনে তিনি নানা রকম সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। কর্মজীবন কর্মজীবনের শুরুতে তিনি আজিয়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় যোগদেন। বেশ কিছুদিন পর তিনি ২০১৯ সালে উন্নত ভবিষ্যতের আশায় কুয়েত পারি জমান। কিন্তু সেখানকার কাজের পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় পুনরায় আবার বাংলাদেশে ফিরে এসে পূর্বের পদে কাজে যোগদান করে অদ্যাবধি কর্মরত আছেন। এছাড়াও তিনি স্বপ্ন গ্রাফিক্স এন্ড নেটওয়ার্ক নামে একটি মাল্টিমিডিয়া এবং প্রিন্টিং প্রেস প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধীকারী সেই সাথে স্বপ্ন ইশকুল নামক একটি কম্পিউটার ট্রেণিং ইনস্টিটিউট এর মালিকানায় আছেন যেখানে তিনি নিজেই ক্লাস পরিচালনা করেন। লেখা-লেখি ও সাহিত্য কর্ম ছাত্র অবস্থায় তিনি লেখা-লেখি ও সাহিত্য কর্মের সাথে জড়িত আছেন। ২০১১ সালে রাইটার্স এসোসিয়েশন এর ম্যাগাজিনে তার প্রথম লেখা বন্ধু চিরন্তন প্রকাশিত হয়। এর পর তিনি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Close

অ্যাডস্ ব্লকার পাওয়া গেছে!

দয়া করে আমাদের সাপোর্ট করার জন্য আপনার এডস্ ব্লকার ডিজেবল করে পেইজটি রিলোড করুন! ধন্যবাদ